হাফিজুর রহমান আকাশ, বিশেষ প্রতিনিধি।।
বঙ্গোপসাগরে চলছে ২১ মে থেকে মাছ না ধরার ৬৫ দিনের অবরোধ। তবে এই সময়ের ভেতর আইনের তোয়াক্কা না করে জেলেরা অবাধে মাছ ধরছেন। এ অবরোধ উপেক্ষা করে সমুদ্রে যেন চলছে জেলেদের মাছ শিকারের মহাউৎসব। নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, থানা পুলিশ ও মৎস্য কর্মকর্তাদের সামনেই মাছশিকার, বিক্রি এবং বাজারজাত করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
প্রকাশ্যেই জেলেদের ধরা এসব মাছ খোলা বাজারে বিক্রি, বাজারজাত, পরিবহন করা হচ্ছে। সমুদ্রে জেলেদের অবাধ বিচরণ মৎস্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নীরবতা জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
রূপালী ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য রক্ষায় সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে জেলেদের অবরোধকালীন সময়ে মাছ শিকারে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে মৎস্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। মাঝে মধ্যে অভিযানের নামে চলছে নাটকীয়তা এমনটাই অভিযোগ উপকূলবাসীর।
কুয়াকাটা, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আলীপুর-মহিপুরসহ উপকুলীয় এলাকার একই চিত্র দেখা গেছে। অবরোধে সমুদ্রে মাছ শিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসন বলছেন মৎস্য কর্মকর্তাদের কথা আর মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন প্রশাসনের কথা।
সরেজমিনে দেখাগেছে, আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ইলিশ, পোয়া, লইট্যা, ডাডিসহ সামুদ্রিক মাছের স্তুপ। আহরিত মাছের চলছে বাছাই প্রক্রিয়া। যথানিয়মে খোলাবাজারে ডাকের মাধ্যমে কেনাবেচা হচ্ছে মাছগুলো।
দেশের সমুদ্রসীমানায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাকালীন সময় সমুদ্রে মাছ শিকার, সংরক্ষণ ও বিপণন নিষিদ্ধ হলেও সবকিছুই চলছে প্রকাশ্যে। একই অবস্থা সরকারি দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আলীপুর-মহিপুর, কুয়াকাটা পৌর মার্কেট ও গঙ্গামতি এলাকার সামুদ্রিক মাছের আড়ৎঘাটে।
নিষেধাজ্ঞা পালনকারী জেলেরা জানিয়েছেন, তদারকির দায়িত্বে থাকা জেলা, উপজেলাসহ স্থানীয় প্রশাসনের গোপন যোগসাজশে মাছ শিকার, বাজারজাতকরণ এসব কাজ চলছে অবাধে। একাদিক জেলে জানিয়েছেন, সমুদ্রে মাছ শিকার কাগজ-কলমে চলছে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
৬৫ দিনের এ দীর্ঘ সময়ে সমুদ্রে মাছ শিকারে না যাবার জন্য জেলেরা সরকারি সহায়তার আওতায় রয়েছে। বাস্তবে কিছু প্রভাবশালী ফিশিং ট্রলার মালিকরা জেলেদের সমুদ্রে মাছ শিকারে যেতে বাধ্য করছেন। এর মধ্যে পুলিশ প্রশাসন কয়েকদফা রুটিন মাফিক লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে জেলেদের আটকসহ আর্থিক জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। জনবল ও নৌযানের স্বল্পতার অজুহাত ছাড়া কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, নিজামপুর কোষ্টগার্ড, কুয়াকাটা নৌ-পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকায় সরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রসহ সামুদ্রিক মাছের আড়তঘাটে দেদারচ্ছে কেনাবেচা হচ্ছে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ।
অভিযোগ রয়েছে, কুয়াকাটা পৌরসভার মৎস্য আড়দদাররা কুয়াকাটা সৈকতে নিষেধাজ্ঞাকালীন অন্তত ৫ শতাধিক নৌকার দেড় হাজার জেলেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে পাঠিয়েছে। এজন্য প্রতিটি নৌকাকে গুনতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, মহিপুর-আলীপুর পোতাশ্রয় থেকে প্রায় দেড় শতাধিক ট্রলার গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকারে রয়েছে। এমনকি আহরিত মাছ সংরক্ষণ, মজুদ ও বাজারজাত কারণে বরফ উৎপাদনের মিলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সচল রাখা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, কুয়াকাটা নৌপুলিশ ফাঁড়ির সামনেই সমুদ্রে জেলেরা দেদারছে মাছ শিকার করছে। অভিযানের সময় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে অভিযান না চালিয়ে, অভিযান চালানো হয় রাঙ্গাবালী এলাকার সমুদ্রে।
নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক অনেকেই জানান, কুয়াকাটা ও আলীপুর-মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মাছধরা ট্রলার মালিক এবং আড়তদারদের সাথে সখ্যতা থাকায় এসব জেলেদের ধরছে না নৌপুলিশ কিংবা কোস্টগার্ড।
কলাপাড়া উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি সমিতির সভাপতি নুরু মাঝি বলেন, আড়তগুলোতে যেসব মাছ বিক্রি হচ্ছে সবই সমুদ্রের মাছ। যা নদীর মাছ বলে চালিয়ে নিচ্ছে আড়তদার, প্রশাসন এবং মৎস্য কর্মকর্তারা।
আলীপুর-মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক শাকিল আহম্মেদ বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জেলেদের আহরিত মাছ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। কোনটি সমুদ্রের এবং কোনটি নদীর। তবে জেলেসহ দাদন ব্যবসায়ীরা নদীর মাছ বলেই বিএফডিসি পাইকারি বাজারে বিক্রি করছেন।
এই অবরোধকালীন সময়ে বিএফডিসির খোলাবাজারে প্রকাশ্যে মাছ বেচা-কেনা নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নদীতে কোনো জেলে নৌকা কিংবা জেলেদের মাছ ধরতে দেখা না গেলেও মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের এই কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের মধ্যদিয়ে প্রমাণ হয় যে মৎস্য অবরোধের নামে চলছে প্রহসন।
কলাপাড়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, নিষেধাজ্ঞাকালীন সমুদ্রে মাছ ধরায় পৃথক অভিযানে অসাধু জেলেদের কারাদন্ডসহ আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। অভিযান চলমান রয়েছে এবং অব্যাহত থাকবে বলে জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।
সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করা ওয়ার্ল্ড ফিস-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকো ফিস-২ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি জানিয়েছেন, প্রশাসনের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সমুদ্রে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন হচ্ছে না। বরফ কলগুলো সচল রাখায় সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণ ও বিপণনে সহায়তা করা হচ্ছে।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম আজাহারুল ইসলাম বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। নিষোধাজ্ঞা কার্যকর করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হবে বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।