আরিফ সুমন (মহিপুর)।
জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ও বনদস্যুদের সাথে বন প্রশাসনের অলিখিত অবৈধ চুক্তির ফলে দিন দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপকূলীয় বনাঞ্চল। দক্ষিনাঞ্চল পটুয়াখালীর মহিপুর থানাধীন কুয়াকাটার গঙ্গামতি সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বেড়ে ওঠা বনাঞ্চল আজ শুধুই ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দান করে। উল্লেখ্য থাকে যে, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ২০০৭ সাল থেকে সাইক্লোন সিডর, আইলা, মহাসিন, নার্গিস ও মোরা, ফনি, সুপার সাইক্লোন আম্ফানের মতো একাধিক প্রাকৃতি দুর্যোগে পাল্টে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলের চিত্র। এ ছাড়াও বনদস্যুদের ক্রমাগত উৎপাতে ধ্বংস হচ্ছে উপকূলের বনাঞ্চল। এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংসে করে চলেছে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কারনে
কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বনাঞ্চল ধংস করে গড়ে ওঠেছে শতাধিক ইটের ভাটা। আর এ সকল ভাটায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ চুরি করে ব্যবহার করছে একদল অসাধু ইট ভাটার ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পরিবেশবান্ধব হওয়ায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। কিন্তু তবুও নদী/জলাশয় ও বনাঞ্চল রক্ষায় উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবে মানছে না কেউ। তছাড়া কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের দেখা যাচ্ছে না সেই নির্দেশনার সঠিক প্রয়োগ। সাগরের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধির সঙ্গে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে কুয়াকাটা, গঙ্গামতি ও সোনারচর সবুজ বনাঞ্চল। সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত হচ্ছে বালুক্ষয়। প্রতিদিনই বালুর স্তর ৫-১০ ইঞ্চি পর্যন্ত নেমে যাওয়ায় গাছ ভেঙে পড়েছে। গাছের গোড়ার মাটি, বালি ধুয়ে যাওয়ায় মরে যাচ্ছে গেওয়া, কেওড়া, ছইলা ও নারিকেল গাছগুলো। সরেজমিনে দৃশ্যমান, কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতের বিখ্যাত ফয়েজ মিয়ার বৃহত্তর নারিকেল বাগান ও ঝাউবন পর্যটকদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। এ ছাড়াও সমুদ্রের পানির বিষাক্ততায় বৃক্ষরাজি মাটি ও বালি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারছে না। যার ফলে গাছের অধিকাংশ পাতা হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সমুদ্র পাড়ের এসব গাছ মরে গেলে প্রকৃতি ও পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।
বন বিভাগ সূত্রমতে, জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোন থেকে রেহাই পাবার জন্য ৬০ দশকে উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণ এর কাজ শুরু হয়। এই বাঁধের বাইরের ভূমিতে বনায়ন করার জন্য ১৯৬৬ সালে তৎকালীন সরকারের বন বিভাগ একটি উদ্যোগ নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় বৃহত্তর পটুয়াখালী জেলায় ৩২০ হেক্টর ভূমি বনায়ন করা হয়। তৎকালীন সময়ে কুয়াকাটার বন্যানিয়ন্ত্রণ ভেড়িবাঁধের বাইরে গঙ্গামতি ও সৈকত লাগোয়া বালুচরে ১ একর (.৫০ হেক্টর) জমিতে এক হাজার ১০০ গেওয়া, কেওড়া, ছইলা গাছসহ বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ জাতের বৃক্ষ রোপন করা হয়। এই বৃক্ষ রোপন করে সূচনা কারা কৃত্রিম বনায়ন । কৃত্রিম বনাঞ্চল এছাড়াও সেখানে প্রাকৃতিক ভাবেও জন্ম নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিশাল সবুজ বনাঞ্চল। যা এখন সম্পূর্ণভাবে বিলিনের মুখে।
মহিপুর বনকর্মকর্তা বলেন, বন বিভাগ ১৯৭৬ সালে উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু দ্বীপ চর, মূলভূমি সংলগ্ন চর এবং উপকূলীয় বাঁধ বনায়ন করে। বর্তমানে এর আওতায় ১৬,৬৯৩ হেক্টর ভূমি রয়েছে। এ ছাড়াও সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকেও বাঁধ ও রাস্তায় বনায়ন করা হয়েছে এবং বন বিভাগ আওতাধীন বনাঞ্চল সুরক্ষিত আছে বিধায় কৃত্রিম বনাঞ্চলের আয়াতন বাড়ছে। এছাড়াও তিনি বলেন, কুয়াকাটা, গঙ্গামতি সহ সকল উপকূলীয় বনাঞ্চলের আওতাধীন বসত বাড়ি ও সকল প্রকার স্থাপনা সরিয়ে দিতে কাজ করছে এই উপকূলীয় বনাঞ্চলের আওতাধীন বন বিভাগ। বৈজ্ঞানিক সূত্রে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় বরফ গলে যাওয়ায় সাগর তলের উচ্চতা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও বন বিভাগের তৈরি করা বনাঞ্চল মরে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সাগরের পানির স্তর ক্রমশই বাড়ছে। এ কারণে বেশি করে গাছ লাগালে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেতে পারে।
স্থানীয় সচেতন মহলের ধারনা, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের তীব্র ভাঙন আর অন্যদিকে বনদস্যুদের অবাদে গাছ কাটার কারণেই উপকূলীয় এলাকার বন গুলোর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বনাঞ্চল রক্ষায় বর্তমান সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে চরম মূল্য দিতে হবে, যার ফলে ভবিষ্যতে প্রানীকূল মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।